| বিএনপির কর্মী কামালের ঘরেই অস্ত্র কারখানা |
🔹 রাউজানে পাহাড়ি বাড়িতে গোপন অস্ত্র কারখানা উন্মোচন, গ্রেপ্তার দুই
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পাহাড়ি জনপদ নোয়াপাড়া— চারদিকে বেতগাছ, পাম, বাঁশঝাড় আর সরু কাঁচা পথ। নির্জন এই এলাকায় এক তিনতলা বাড়িতে চলছিল ভয়ংকর প্রস্তুতি— অস্ত্র তৈরির গোপন কারখানা!
র্যাব-৭ এর গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ওই বাড়িতে রাতের আঁধারে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র তৈরি ও মজুতের কাজ চলছিল। কয়েকদিনের নজরদারির পর বুধবার (৩০ অক্টোবর) রাতেই অভিযান চালানো হয়।
অভিযানে বিপুল পরিমাণ দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় গ্রেপ্তার হয় দুইজন— স্থানীয় বিএনপি কর্মী মো. কামাল উদ্দিন (৫০) ও তার সহযোগী মো. সোহেল আহম্মদ (৪৪)।
🔸 স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা অনুসারী অভিযুক্ত কামাল
গ্রেপ্তার কামাল উদ্দিন স্থানীয়ভাবে ‘কামাল মেম্বার’ নামে পরিচিত। তিনি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান খায়েজ আহমদের ছেলে এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে র্যাব জানিয়েছে।
র্যাব–৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান জানান,
“নোয়াপাড়ার ওই বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র তৈরি ও মজুতের কাজ চলছিল। অভিযানে তিনটি একনলা বন্দুক, ছয়টি ওয়ান শুটার গান, পাঁচটি চাইনিজ কুড়াল, একখানা তলোয়ার, পাঁচটি রামদা এবং দেশীয় অস্ত্র তৈরির অসংখ্য যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকা হওয়ায় অপরিচিত কাউকে দেখলেই চক্রের সদস্যরা সতর্ক হয়ে যেত। এজন্য র্যাব কয়েক সপ্তাহ ধরে গোপনে নজরদারি চালায়।
🔸 যেভাবে বানানো হতো ‘মৃত্যুযন্ত্র’
র্যাব জানায়, কামাল ও সোহেল স্থানীয় কামারদের ব্যবহার করতেন অস্ত্র তৈরির কাজে। পুরনো লোহার রড, মোটরসাইকেলের পাইপ, সাইকেলের ফ্রেম আর মেশিনের স্প্রিং ব্যবহার করে বানানো হতো ব্যারেল ও ট্রিগার।
একজন স্থানীয় কামার জানান,
“ওরা মাঝে মাঝে এসে লোহা কিনতো, পাইপ বা স্প্রিং চাইতো। ভেবেছি মেশিনের কাজ করবে। পরে বুঝি বন্দুক বানায়।”
স্থানীয়রা জানান, কামাল আগে লোহার ব্যবসা করতেন। পরে অপরাধী চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ‘কারিগর’ হিসেবে অস্ত্র বানানোর দিকে ঝুঁকে পড়েন।
🔸 অস্ত্র যেত তিন গ্রুপের কাছে
র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে— এই এলাকায় তৈরি অস্ত্র বিক্রি হতো উপকূলীয় জলদস্যু দল, স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসী চক্রের কাছে।
একনলা বন্দুক বিক্রি হতো ২৫–৩০ হাজার টাকায়, ওয়ান শুটার ১৫–২০ হাজারে।
এক র্যাব কর্মকর্তা জানান,
“এরা অর্ডার অনুযায়ী বন্দুক বানাতো। যে অপরাধী ১২ বোর বন্দুক চাইতো, তার চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হতো অস্ত্র।”
🔸 পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি কাজে লাগিয়ে গোপন কারখানা
রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন,
“এলাকার ভূপ্রকৃতি এমন যে, গোপনে কাজ চালানো খুব সহজ। পাহাড়ের নিচে বা বাঁশঝাড়ের ভেতরে কয়েকজন মিলেই অস্ত্র তৈরির কাজ চালাতে পারে।”
তিনি আরও জানান, স্থানীয়রা ভয় বা প্রভাবের কারণে চুপ থাকে। গত এক দশকে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীতে অন্তত সাতবার অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই কারিগরি ও একই ধাঁচের অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
🔸 পাহাড়ে গড়ে তোলা গোপন নেটওয়ার্ক
র্যাব জানায়, কামাল–সোহেল শুধু একটি জায়গায় নয়, পাহাড়ের গহিনে নতুন নতুন অস্থায়ী কারখানা তৈরি করতো।
স্থানীয়রা জানান, তারা কখনো ধানক্ষেতে, কখনো বাঁশঝাড়ে ছাপড়া ঘরে কাজ করতো। রাতে হাতুড়ির শব্দ ও আগুনের আলো দেখলে সন্দেহ হতো।
একজন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক বলেন,
“আমরা জানতাম কামাল লোহার কাজ করে। কিন্তু অস্ত্র বানায়, এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না।”
🔸 পেছনে প্রভাবশালী অর্থদাতারা
র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে, এই অস্ত্র ব্যবসায় স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন জড়িত। তারা অর্থায়ন ও ‘প্রটেকশন’ দিত।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন,
“এই ধরনের অস্ত্র কারখানা সাধারণত স্থানীয় ক্ষমতাবানদের আশ্রয়ে টিকে থাকে। কারখানার মালিক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে, পেছনে থাকে অর্থদাতা ও ক্রেতা।”
🔸 রাউজানে সহিংসতার প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতায় রাউজান ও আশপাশে ১৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার মধ্যে ১২টি রাজনৈতিক হত্যা। সর্বশেষ গত শনিবার যুবদল কর্মী মুহাম্মদ আলমগীর আলমকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
🔸 নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সতর্কতা
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর এমদাদুল ইসলাম (অব.) বলেন,
“অর্থনৈতিক দারিদ্র্য ও আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে এসব কারিগর অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। এটি কেবল অস্ত্র ব্যবসা নয়— এটি সহিংসতা, মাদক ও চাঁদাবাজির মূল উৎস।”
তিনি আরও বলেন, এসব অস্ত্র শহরাঞ্চলে পৌঁছে গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
গ্রেপ্তার হওয়া দুইজনকে রাউজান থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত অস্ত্র ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। র্যাব–৭ জানিয়েছে, তাদের কাঁচামালের উৎস ও ক্রেতাদের শনাক্তে তদন্ত চলছে, আরও কয়েকটি এলাকায় অভিযান প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে নোয়াপাড়ার সেই বাড়ি সিলগালা করা হয়েছে, তবে পাহাড়ি গ্রামের মানুষের মনে এখনও আতঙ্ক। স্থানীয়দের প্রশ্ন— “ধরা পড়ল দুজন, কিন্তু যারা পেছনে থেকে এই মৃত্যুযন্ত্রের ছক করেছিল, তারা কি কখনো ধরা পড়বে?”
No comments:
Post a Comment