খোলাফায়ে রাশেদার যুগে বিচারব্যবস্থা যেমন ছিল |
খোলাফায়ে রাশেদার যুগের বিচারব্যবস্থা: সুবিচার প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
পিপলস বাংলা ডেস্ক:
ইসলামী ইতিহাসের এক অনন্য ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হলো খোলাফায়ে রাশেদার যুগ। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত এই সময়কালে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি খুঁটিনাটিতে ন্যায়বিচার, ইনসাফ ও মানবিক মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়। বিশেষ করে বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে তাঁরা এমন উদাহরণ রেখে গেছেন, যা আজও বিশ্বমানবতার জন্য অনুকরণীয়।
বিচারব্যবস্থার মূল লক্ষ্য
খোলাফায়ে রাশেদার আমলে বিচারব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল— ধনী-গরিব, শক্তিশালী-দুর্বল নির্বিশেষে সবার জন্য ন্যায়ভিত্তিক ফায়সালা নিশ্চিত করা। কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে—
"তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো, আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাক্ষ্য দাও— তা নিজের, পিতা-মাতা কিংবা আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধেও হোক" (সুরা নিসা, আয়াত: ১৩৫)।
এই আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদার কোনো প্রকার ছাড় দেননি।
খলিফা নিজেই আদালতের কাঠগড়ায়
খলিফা আলী (রা.)-এর বর্ম চুরির ঘটনা সুবিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এক ইহুদির কাছে বর্মটি দেখে তিনি বিচারকের কাছে যান। কিন্তু সাক্ষীর মানদণ্ডে তাঁর পুত্র ও দাসের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিচারক বর্ম ফিরিয়ে দেন সেই ইহুদিকেই। পরবর্তীতে এই সুবিচারে মুগ্ধ হয়ে ওই ইহুদি ইসলাম গ্রহণ করেন।
একইভাবে, খলিফা ওমর (রা.) নিজ পুত্রকে মদ্যপানের অপরাধে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন, যা পরিণামে তাঁর মৃত্যু ঘটায়।
প্রতিটি যুগে বিচারব্যবস্থার বিকাশ
আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে, বিচারকার্যে সহায়তা করতেন ফকিহ সাহাবিরা। গভর্নররাই ছিলেন বিচারক, এবং খলিফা নিজেও মদিনায় বিচার করতেন।
ওমর (রা.)-এর শাসনামলে, বিচারব্যবস্থা আলাদা বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে বিচারক নিযুক্ত হন। বিচারকদের জন্য নির্ধারিত বেতন ও দায়িত্ব ছিল। এমনকি গভর্নররাও ন্যায়ের প্রশ্নে বাধ্য থাকতেন।
উসমান (রা.), একদিকে নির্দিষ্ট বিচারক নিয়োগ করলেও কখনো কখনো গভর্নরদের বিচারিক ক্ষমতা দিতেন। এতে প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়।
আলী (রা.), নিজে কুফায় বিচার করতেন এবং বেশ কিছু বিচারক নিয়োগ করেন।
সুবিচার ও শাসকের নতশীরতা
খোলাফায়ে রাশেদার যুগে শাসক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ন্যায়ের দৃষ্টিতে কোনো পার্থক্য ছিল না। উমর (রা.) নিজেই সাধারণ এক সাহাবির সঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিষয়ে বিচারকের দরজায় হাজির হন। বিচারক তাঁকে বিশেষ সম্মান দেখাতে চাইলে উমর (রা.) তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, "আমি প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমানভাবে বসব।"
বিচারের পরিমাণ ছিল অল্প
তৎকালীন সমাজে ঈমান, তাকওয়া ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এতটাই সুদৃঢ় ছিল যে, বিচারপ্রার্থীর সংখ্যা ছিল নগণ্য। সালমান ইবনে রাবিআ (রা.) কুফার বিচারক ছিলেন; চল্লিশ দিনেও কোনো অভিযোগ বা অপরাধী আসেনি তাঁর দরবারে।
অপরাধপ্রবণতা নিরুৎসাহিত হতো
তৎকালীন রাষ্ট্র জনগণকে অপরাধ স্বীকারে উৎসাহিত করত না; বরং তাওবা ও আত্মশুদ্ধির দিকে আহ্বান জানাত। খলিফা উমর (রা.) একবার বলেন, "যদি কোনো নারী দুষ্কর্ম করে, তবে তা গোপন রাখো— শুধু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করো।"
বিচার কার্যক্রমে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ
কোরআন-সুন্নাহ, ইজমা, ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো সব বিচার। কিসাস, পারিবারিক, আর্থিক এবং ফৌজদারি সকল বিষয়েই ন্যায়ের সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হতো। বিচারকরা বিচার পরিচালনা করতেন মসজিদে, কখনো কখনো নিজ বাড়িতেও।
উপসংহার:
খোলাফায়ে রাশেদার যুগে বিচারব্যবস্থা ছিল প্রকৃত ইসলামি ইনসাফের প্রতিচ্ছবি। এই যুগের আদর্শ সমাজে সুবিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। আজকের সমাজ যদি এই আদর্শ অনুসরণ করে, তবে নিশ্চয়ই ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
No comments:
Post a Comment