নিভে যাওয়ার আগে যে আলো জ্বেলে দিলেন দুই বীর - People’s Bangla

People’s Bangla

Voice of the People | জনতার কণ্ঠস্বর

সর্বশেষ

Home Top Ad

Post Top Ad

Monday, October 13, 2025

নিভে যাওয়ার আগে যে আলো জ্বেলে দিলেন দুই বীর

নিভে যাওয়ার আগে যে আলো জ্বেলে দিলেন দুই বীর

তানজিম ও নাজিম: নীরব দুই বীরের গল্প — সেনাবাহিনীর প্রামাণ্যচিত্র ‘অনির্বাণ’ কাঁপালো হৃদয়

ডেস্ক রিপোর্ট | পিপলস বাংলা নিউজ

কিছু মৃত্যু ঘটে প্রচণ্ড শব্দে—বুলেটের ঝাঁজে, বিস্ফোরণের তাপে কিংবা চিৎকারের প্রতিধ্বনিতে। আবার কিছু মৃত্যু হয় নিঃশব্দে, অথচ কাঁপিয়ে দেয় অন্তরকে। সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জন এবং মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিনের মৃত্যু এমনই দুটি নীরব বিস্ফোরণ, যা জীবনের মূল্য ও মানবিকতার সৌন্দর্য নতুনভাবে ভাবতে শেখায়।

তাদের আত্মত্যাগের গল্প উঠে এসেছে সেনাবাহিনীর ৪০ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র ‘অনির্বাণ’-এ, যা প্রকাশ করা হয় গত শুক্রবার রাত ৯টায়। ভিডিওটি প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।


তানজিম: গুলি না করে ধরতে গিয়েছিলেন, প্রাণ দিলেন

২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজারের চকরিয়ার পাহাড়ঘেরা মাইজপাড়া গ্রাম। রাতে ডাকাতি ঠেকাতে সেনা ও পুলিশের যৌথ অভিযান। নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ২৩ বছর বয়সী লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জন। নির্দেশ ছিল স্পষ্ট—‘ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোনোভাবেই গুলি চালানো যাবে না।’

তানজিম দূর থেকে দেখেন দুইজন ডাকাত পালাচ্ছে। তিনি গুলি না করে ছুটে গিয়ে খালি হাতে একজনকে ধরেন। ঠিক তখনই অপর ডাকাত ছুরি বের করে আক্রমণ করে—মাথা ও ঘাড়ে একের পর এক ছুরিকাঘাত। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন তানজিম।

সহযোদ্ধারা বলেন, তিনি চাইলে গুলি করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। কারণ, তিনি জানতেন, সামনে মানুষ আছে। জীবন নেওয়ার চেয়ে জীবন বাঁচানোই ছিল তার কাছে বড় বিষয়

তানজিমের মৃত্যু শুধু একটি অভিযান শেষ করেনি, বরং মানবতার এক নতুন আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।


নাজিম: মৃত্যুর মুখে বলেছিলেন, ‘অস্ত্রটা নিয়ে যা, আমি থাকব’

‘অনির্বাণ’-এর দ্বিতীয় গল্প আরও হৃদয়বিদারক। ২০১৩ সালের ১২ মার্চ, পাহাড়ি অঞ্চলে বন্যা-পরবর্তী চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়েছিলেন সেনা সদস্যরা। ফেরার পথে অতর্কিত হামলায় গুলিবিদ্ধ হন মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন

সহযোদ্ধা কাছে এগিয়ে আসতেই নাজিম বলেন,
“তুই শোন... আমি যেতে পারব না... আমার অস্ত্রটা নিয়ে যা, যেন ওদের হাতে না পড়ে।”

অস্ত্রের নিরাপত্তাকে নিজের জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন তিনি। শেষ মুহূর্তে সহযোদ্ধাকে বলেন, “তুই চলে যা, আমি থাকব। আমাদের কাজ শেষ হয়নি।”

এ যেন মৃত্যু নয়, এক অমর দায়িত্ববোধ—যেখানে আলো নিভে গেলেও আরেক আলো জ্বলে ওঠে পরের হাতের মশালে।


তানজিমের পরিবারে এখনো শোকের ছায়া

লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ারের বাড়ি টাঙ্গাইলের তিন বেতকা গ্রামে। বাবা সারোয়ার জাহান (দেলোয়ার) ও মা নাজমা বেগম এখনও ছেলের স্মৃতিতে পাথর হয়ে আছেন।
মা বলেন, “ছেলেকে যুদ্ধের মাঠে পাঠাইনি, মানুষ বাঁচাতে পাঠিয়েছিলাম। সে নিজের কথা না ভেবে বাঁচাতে গিয়েছিল আরেকজনকে।”

তানজিম পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ৮২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে ২০২২ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশন লাভ করেন।


‘অনির্বাণ’ দেখেছে তরুণ প্রজন্ম, কেঁদেছে অনেকেই

চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর এই প্রামাণ্যচিত্র তাদের গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আতিকুর রহমান বলেন, “তানজিমের ঘটনা দেখার পর মনে হলো, এই দেশে এমন মানুষও আছে! তিনি গুলি না করে খালি হাতে ধরতে গিয়েছিলেন—এটা শুধু ডকুমেন্টারি না, আত্মার ওপর ছাপ ফেলা কিছু দৃশ্য।”

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সজিব ওয়াজেদ বলেন, “নাজিম উদ্দিন যখন অস্ত্রটা দিয়ে বললেন ‘তুই চলে যা’, ওই দৃশ্যটা আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। এটা সিনেমা না, সত্যিকারের বীরের গল্প।”


শেষ কথা

৪০ মিনিটের ‘অনির্বাণ’ কেবল সেনাবাহিনীর ভিডিও নয়—এ এক নীরব শোকগাথা।
তানজিম ও নাজিমের মতো সৈনিকেরা হয়তো আর ফিরবেন না, কিন্তু তাদের মানবিকতা ও আত্মত্যাগ চিরজীবী হয়ে থাকবে এই মাটিতে।

No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad

© 2025 Peoples Bangla | All Rights Reserved.
×